🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

বাংলার এক কোণায়, যেখানে পাকা রাস্তা শেষ হয়ে ধুলোমাখা কাঁচা পথ শুরু হয়, সেই অজানা গ্রামটার নাম অচিনপুর। খুব বেশি কেউ চেনে না এই জায়গাটাকে — না কোনো মানচিত্রে, না কারো স্মৃতিতে। যেন একটা হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের মতো, কুয়াশা ঢাকা ভোরে যার অস্তিত্ব বোঝা যায় শুধু তার নিঃশব্দ সৌন্দর্যে।

সেই গ্রামে বাস করে রঘু, একজন চিত্রশিল্পী — যদিও সে নিজেকে কখনো “শিল্পী” বলে পরিচয় দেয় না। তার জন্য ছবি আঁকা মানে কোনো পেশা নয়, একধরনের প্রার্থনা।  

তার বয়স এখন প্রায় চল্লিশ, কিন্তু চেহারায় একরকম সময়হীনতা রয়েছে। যেন তার চোখ দুটো বহু বছর ধরে দেখে চলেছে এমন কিছু যা আমরা কেউ দেখার সময় পাই না।

রঘুর জন্মও এই গ্রামেই। বাবার ছিল একখানি ছোট পানের দোকান। সংসার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। ছোটবেলাতেই মা হারান, আর বাবা কড়া হাতে মানুষ করতেন। বই-খাতা যতটা দরকার, তার বাইরে কিছু না।  

তবে রঘুর মন তো বাঁধ মানত না — সে দুনিয়াটাকে দেখতে চাইত রঙে, আকারে, আলো-ছায়ায়।  

মাটিতে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা তার প্রথম চিত্র — একটা গরুর গাড়ি, পাশে বসে থাকা ছোট্ট একটা ছেলে। বাবা দেখে বলেছিলেন, "এসব হাবিজাবি করলে পেটে ভাত জুটবে না, শিখ কিছু কাজের জিনিস।" কিন্তু রঘুর মনে তখনই ছুঁয়ে গিয়েছিল আঁকার স্বাদ।

বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চললেও, তার মনটা যেন খাতা আর কলমে আটকে থাকত না। সে ছুটে যেত নদীর পাড়ে, মাঠের ধারে, পুকুরঘাটে। সেখানেই সে খুঁজে পেত চরিত্র — যারা ধরা দিত তার আঁকায়। কৃষকের পরিশ্রান্ত চোখ, হাটে দাঁড়িয়ে থাকা মাছওয়ালার কৌতূহলী মুখ, কিংবা কিশোরীর অলক্ষ্যে দেখা স্বপ্ন।

রঘুর কাছে ক্যানভাস বলতে ছিল পুরনো খবরের কাগজ, মাটির দেয়াল, কাঠের পুরনো ফলক। রং জোগাড় করত সে নিজে — গাছের পাতা থেকে সবুজ, মাটি থেকে বাদামি, পুড়নো কয়লা থেকে কালো।  

গ্রামের লোকে প্রথমে তেমন পাত্তা দেয়নি, কেউ কেউ তো উপহাসও করত, “দেয়ালে আবার ছবি আঁকে কে?”  

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবাই বুঝতে শুরু করল — রঘুর তুলি যেন গ্রামটাকে কথা বলাতে পারে।  

একবার শীতকালে সে আঁকল স্কুলের দেয়ালে — একটা বিশাল গ্রামীণ জীবনচিত্র। ছোটরা অবাক হয়ে দেখল, যেন দেয়ালের মানুষগুলোও ওদের সঙ্গে খেলতে চাইছে। শিক্ষকরা বললেন, "এইটা তো একেবারে শহরের গ্যালারিতে যাওয়ার মতো!" কিন্তু রঘু শুধু হাসল, "এই দেয়ালই আমার গ্যালারি, মাস্টারমশাই।"

বছর পাঁচেক আগে একটা বড় পরিবর্তন আসে। কলকাতা থেকে এক ফটোগ্রাফার আসে অচিনপুরে, প্রকৃতি ও গ্রামীণ জীবনচিত্র ক্যামেরাবন্দি করতে। সে রঘুর আঁকা দেয়ালচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। ছবি তোলে, শহরে ফিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। পোস্টটা ভাইরাল হয়।

একটা নামি গ্যালারির কিউরেটর যোগাযোগ করে রঘুর সঙ্গে — শহরে এসে প্রদর্শনী করতে বলল। এককালীন মোটা টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব দেয়।  

গ্রামের সবাই তো উত্তেজিত, "চল রঘু, এখনি তোর সময়!"  

কিন্তু রঘু চুপ করে থাকে। শেষে শুধু বলল,  

"আমার ছবি তো এখানকার মাটির গন্ধ মেখে বাঁচে। শহরে নিয়ে গেলে তার দম আটকে যাবে।" 

সে যায় না। তার ছবি এখনো থাকে অচিনপুরেই। ধানক্ষেতের পাশে, পুকুরঘাটের দেওয়ালে, কিংবা কোনো পুরনো ভাঙা চালার গায়ে।

রঘু কোনোদিন সেলিব্রিটি হতে চায়নি। সে চায়, তার আঁকা দেখে কোনো বাচ্চার মুখে হাসি ফুটুক, কোনো বুড়ো মানুষ তার পুরনো দিনগুলো মনে করে একবার চোখ মুছুক।

আজকাল সে মাঝে মাঝে গ্রামের স্কুলে ছোটদের আঁকা শেখায়। কারো খাতা নেই, কেউ রঙ আনতে পারে না — তবু রঘু বলে, "রঙ তো বাইরের জিনিস না, ভেতরে যা আছে, সেটা বের করাই আসল।"

রঘুর জীবনটা হয়তো শহুরে চোখে খুব সাধারণ, খুব নিস্তরঙ্গ। কিন্তু তার প্রতিটি ছবিতে যে নিঃশব্দ গল্পগুলো বলা হয় — সেগুলো হয়তো কোনো শব্দেই ধরা যায় না।  

সে কোনো পুরস্কার পায় না, না বড় কোনো শিরোনামে উঠে আসে তার নাম। তবুও সে বাংলার এক অজ পাড়ায়, প্রতিদিন তুলিতে জীবন আঁকে — নিঃশব্দে, ভালোবাসায়, পূর্ণতায়।

___