আস্থা - ডঃ অসিত কুমার মাইতি (২য় পর্ব)
ভীমডাঙা গ্রামের সকালগুলো
হয় চুপচাপ। কেউ খুব জোরে কথা বলে না। শুধু স্কুলের ঘন্টা, ছেলেমেয়েদের কাঁচা গলার
আওয়াজ, আর মন্দির থেকে আসা ধূপের গন্ধ।
এই নিরব ছন্দ ভাঙল এক
অচেনা মানুষের আগমনে।
হঠাৎ আগন্তুক
সেদিন সকালবেলা হেডমাস্টার
মহাশয় রুমে ঢুকে জানালেন, “আজ থেকে একজন নতুন শিক্ষক যোগ দিচ্ছেন। কলকাতা থেকে
এসেছেন। উচ্চতর গণিত পড়াবেন।”
তার নাম—ঋষি ঘোষ। বয়স হবে
ত্রিশ কি বত্রিশ। হালকা পাতলা গড়ন, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মুখে কাটা দাগ—যেটা
সে গোঁফের নিচে লুকিয়ে রাখে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, তার চোখ। ঋষির চোখ দুটো
যেন ধোঁয়ায় ঢাকা—অদ্ভুত, দৃষ্টিহীন না হয়েও এমন যেন অনেক কিছু দেখে ফেলে, যা বলা
যায় না। আদিত্য প্রথম দিনেই টের পায় কিছু—এই লোকটা যেন তাকে ‘চেনে’।
অতীতের প্রতিচ্ছবি
ঋষিকে দেখে হঠাৎই আদিত্যর
মনে পড়ে যায় অনেক বছর আগের একটা বিকেল। শিয়ালদহ স্টেশনের ধারে এক ঝড়বৃষ্টির মধ্যে
সে ও সুরভি একটা দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল।
তখনই এক ছেলে—অল্প বয়সী,
কাঁদছিল। মুখে ছিল ক্ষত।
সুরভি ছুটে গিয়ে তাকে আদর
করেছিল। বলেছিল, “তোমার নাম কী?”
সে বলেছিল, “ঋ… ঋষি।” আদিত্য চোখ বুজে ভাবল,
“অসম্ভব! এটা কি সেই ছেলেটা?”
কিন্তু এও সম্ভব—এমন নাম
তো হতেই পারে। ক্ষত তো অনেকেরই থাকে।
তবু, একটা অস্বস্তি পিছু
ছাড়ে না।
অশুভ সংকেত
ঋষি খুব ভালো পড়ায়।
ছাত্ররা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামের চারপাশে অদ্ভুত ঘটনা
ঘটতে শুরু করে।
মন্দিরের দরজা এক রাতে
নিজে থেকে খুলে যায়। গ্রামের একজন বৃদ্ধ বলে, সে রাতে দেখেছে মন্দিরের ভেতরে ছায়ার
মতো কিছু ঘুরছে মন্দিরের পাশের বটগাছে একদিন ভোরে পাওয়া যায় রক্তমাখা রুদ্রাক্ষ। গ্রামজুড়ে
গুজব ছড়াতে শুরু করে—“দেবতা রেগে গেছেন।”
আর কিছু লোক বলতে শুরু করে—
“ঋষি ঘোষ এল আর তার পর থেকেই এসব শুরু...”
প্রথম সংঘর্ষ
একদিন সন্ধ্যাবেলা আদিত্য
মন্দিরে বসে ধ্যান করছিল। চোখ বন্ধ করে সে শিব মন্ত্র জপছিল— “ওঁ নমঃ শিবায়… ওঁ
নমঃ শিবায়…”
হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস
আসে, যেন ভিতর থেকে কে যেন তাকে ছুঁয়ে গেল। চোখ খুলে দেখে—ঋষি দাঁড়িয়ে, চুপচাপ।
সে বলে— “আপনি বিশ্বাস করেন
শিবকে?”
আদিত্য জবাব দেয়, “আমি
শুধু বিশ্বাসই করি না… আমি তাঁকে দেখি।”
ঋষির ঠোঁটে হালকা হাসি।
“যদি বলি, শিবই একদিন
আপনার সব কিছু কেড়ে নিয়েছেন?”
আদিত্য: “তাঁর যা ইচ্ছা, আমি তাই নিয়েছি। কারণ
আমি জানি, উনি ফেরতও দিতে পারেন।”
ঋষি কিছু না বলে চলে যায়। কিন্তু
যাওয়ার আগে ফিসফিস করে বলে— “প্রতিশোধও এক ধরণের প্রার্থনা, মশাই…”
রাতের খুন
পরের দিন ভোরে পুরো গ্রাম
চমকে ওঠে। গ্রামের এক বৃদ্ধ, যিনি আদিত্যর পরিবার ধ্বংসের সময় একমাত্র সাক্ষী
ছিলেন—শিবু পাল—তার মৃতদেহ পাওয়া যায় গঙ্গার ঘাটে।
চোখ দুটো খোলা, জিভ
বেরোনো, আর কপালে রক্ত দিয়ে আঁকা “ত্রিশূল” চিহ্ন।
পুলিশ আসে। প্রাথমিক
রিপোর্টে বলে—হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু আদিত্য জানে—এটা মৃত্যু নয়, এটা বার্তা।
সেদিন রাতে আদিত্য তার
ঘরের কোণে বসে পাণ্ডুলিপির পুরোনো পৃষ্ঠাগুলো দেখে। সেখানে লেখা— “যে দেবতার নাম
জপ করো, সে যদি নেমে আসে, তার রোষও বইতে পারো কি?”
আর ঠিক তখনই, জানালার পাশে
দাঁড়িয়ে, অন্ধকারের মধ্যে থেকে এক ছায়া চুপি চুপি বলে ওঠে— “সব কিছু এখনও শেষ
হয়নি, আদিত্যদা। এবার আপনার পালা।”
আদিত্য ফিরে তাকায়।
জানালায় কেউ নেই। কিন্তু হাওয়া গায়ের মধ্যে দিয়ে এমন ভাবে বয়ে যায়, যেন কারো
দৃষ্টি এখনও ঠিক তার হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে আছে।
(চলবে…)
Comments
Post a Comment