দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি
পর্ব ১: কাদায় মিশে থাকা ক্যানভাস
![]() |
“ও চোখ দিয়ে আঁকে, হাত দিয়ে নয়।’’ |
ধনীবাঁধ গ্রামের আকাশটাও যেন অন্যরকম ছিল। কখনো থমথমে, কখনো ধু-ধু। কিন্তু ছোট্ট সনাতন ঘোষ সেই আকাশের নিচে অন্য এক পৃথিবী খুঁজত। তার বয়স যখন আট, তখন তাকে পাওয়া যেত পুকুরের পাড়ে, যেখানে সে লতাপাতা, মাটি, ছেঁড়া কাগজ দিয়ে কিছু না কিছু আঁকত। কেউ একে খেলা ভাবত, কেউ "বোকামো" বলত। কিন্তু মা বলতেন, “ও চোখ দিয়ে আঁকে, হাত দিয়ে নয়।’’
বাবা ছিলেন সহজ মানুষ। ভোরে মাঠে যেতেন, সন্ধ্যায় ফিরতেন নীরব হয়ে। সংসার চলত খড়ের চাল, একটা ভাঙা চৌকি আর ঝুড়িভর্তি স্বপ্ন নিয়ে। সনাতন যখন মাটি দিয়ে প্রথম গরুর ছবি আঁকে, বাবা হেসে বলেন, “গরুটা কাঁদায় হাঁটছে, রে! তুই তো সত্যিই আঁকছিস!”
প্রথম স্কুলে যাওয়া হয় আট বছর বয়সে। হাতে ছেঁড়া খাতা, পকেটে পেন্সিল। শিক্ষকরা সনাতনের খাতায় অংক বা বাংলা না দেখে বিরক্ত হতেন। “তুই তো সব পাতায় শুধু আঁকা আঁকিস! এভাবে কিছু হবে না।”
কিন্তু তার একটা শিক্ষক ছিল—হরিপদ মাস্টার। সাদা ধুতি, পাতলা চশমা আর একরাশ মমতা নিয়ে বলতেন, “ওর খাতা না, ক্যানভাস। সময় এলে বুঝবি।”
সনাতনের মনে সেই সময় ‘শিল্পী’ হওয়ার ইচ্ছেটা বীজের মত বপন হয়। কিন্তু জীবন এত সহজ ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বাবার মৃত্যু হয়। কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যায়, মা লোকের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। সনাতনের হাতে সময় তখন দুই রকম—একটা সময় স্কুলে লেখাপড়া, অন্যটা ঘরে কাজ আর রাতে আলো কমিয়ে আঁকা।
একদিন সে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া ক্যালেন্ডারের ছবির ওপরে নিজের ছবি আঁকে। মায়ের চোখে জল এসে যায়। মা বলল, “তোর জীবনেও তেমন রঙ আসুক বাবা…”
তবে সময় তখন দারিদ্র্যের আঁধারে। চারদিকে অবজ্ঞা, হাসাহাসি। প্রতিবেশীরা বলে, “ছবি এঁকে কি কেউ পেট ভরে?”
একদিন গ্রামের চায়ের দোকানে কেউ জোরে বলে উঠল, “তুই যদি আর্টিস্ট হবি, তাহলে আমরা সবাই শিল্পমন্ত্রী!” চারপাশে হাসি, সনাতন মাথা নিচু করে চলে যায়।
তবে তার মন না ভাঙে। আঁকাআঁকি ছাড়ে না। গ্রামের মাঠে, হাটের ভিড়ে বসে বসে মানুষের মুখ আঁকে। মাঝে মাঝে কেউ এসে ছবি চেয়ে নেয়। কোনো মা চায় ছেলের ছবি, কেউ নিজের কুড়ানো ফুল আঁকিয়ে নেয় কাগজে।
সনাতন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে একদিন একটা আঁকার স্কুল করব, যেখানে কেউ আর বলবে না—ছবি এঁকে কিছু হয় না।
এই ইচ্ছেই তার বুকে গেঁথে বসে যায়। কাদায় পা ডুবিয়ে হাঁটলেও, চোখে তার ক্যানভাসের মতো স্বপ্ন ভরে ছিল।
(চলবে...)
Comments
Post a Comment