আস্থা - ডঃ অসিত কুমার মাইতি (১ম পর্ব)
বছরের শেষ ছিল ডিসেম্বর,
রাতের আকাশে কুয়াশা নামছে ধীরে ধীরে, আর জঙ্গলপথে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে উড়ছিল বাতাস।
চারিদিকে এমন একটা নিঃস্তব্ধতা, যেন কেউ নিঃশব্দে নজর রাখছে। ঝাড়গ্রামের গহীন
অরণ্যের মাঝে এক নাম-না-জানা গ্রাম—ভীমডাঙা।
এই গ্রামের প্রান্তেই ছিল
একটা পুরনো, মাটির দোচালা কুঁড়েঘর, যার পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল এক
শতাব্দীপ্রাচীন শিবমন্দির। এখানে দিনের আলো ঢোকে না ঠিকমতো, রাত হলে বাতাস ঠান্ডা
নয়, বরং ভারি হয়ে ওঠে। লোকমুখে শোনা যায়—এই মন্দিরে ভগবান শিব নিজে বসবাস করেন।
লোকেরা বলেন,
“এই দেবতা নীরব… কিন্তু
চোখ বুজে থাকেন না।”
এই গ্রামের একমাত্র
স্কুলের শিক্ষক—আদিত্য চক্রবর্তী—এই কুঁড়েঘরেই থাকে।
তার বয়স এখন ৩৫, এক
নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে। কিন্তু তার চোখে এমন কিছু আছে যা কেবল একবার যুদ্ধে হেরে
যাওয়া সৈনিকের চোখেই দেখা যায়। প্রতিদিন ভোরবেলা সে উঠে পড়ে, স্নান করে, সাদা ধুতি
পরে, তারপর শিবমন্দিরে গঙ্গাজল দিয়ে পুজো করে। আর তারপর স্কুলে যায়।
কিন্তু এই চেনা দিনের
আড়ালেও লুকিয়ে আছে এমন একটা অতীত, যা কেউ জানে না।
অতীত: ছাইয়ের নিচে আগুন
তখন সে কলেজে পড়ে কলকাতায়।
শহুরে জীবনের মাঝে গড়ে উঠেছিল তার এক মধুর প্রেম—সুরভি নামের এক মেয়ের সঙ্গে। ওরা
দুজনেই ব্রাহ্মণ, সংস্কৃতির ভক্ত, ভগবানে বিশ্বাসী। তাদের প্রেম ছিল যেন
পরিপূর্ণ—দুর্গাপূজার রাতে মণ্ডপে হাতে হাত ধরে দাঁড়ানো, রবীন্দ্রসংগীতে একসাথে
ডুবে যাওয়া, আর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বুক ভরে ওঠা।
কিন্তু ভালোবাসা সবসময় সহজ
হয় না।
সুরভির পরিবার এক প্রভাবশালী
ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে দেয়। আদিত্য বাধা দিয়েছিল, কিন্তু হেরে গিয়েছিল
বাস্তবের কাছে।
সেদিনের পর থেকে সে নিখোঁজ
হয়েছিল এক মাস। কেউ জানে না সে কোথায় ছিল। পরে জানা যায়—তার গ্রামে হঠাৎ এক রাতে
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যেখানে তার মা, বাবা ও ছোট ভাই—সবাই মারা যায়। শোনা যায়,
আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি।
কেউ বলে,
“ওটা দুর্ঘটনা নয়। কেউ
ইচ্ছা করেই করেছিল।”
সেই রাত থেকেই আদিত্যর
জীবন বদলে যায়। শহর ছেড়ে সে ফিরে আসে ভীমডাঙা গ্রামে—যেখানে কেউ তাকে চেনে না,
যেখানে সে নিজেকে ভগবানের আশ্রয়ে গুটিয়ে নেয়।
বর্তমান: নীরব দেবতা
সেই রাতের পর আদিত্য নিজের
জীবনের উদ্দেশ্য একটাই করেছে—শিক্ষা ও শিবসেবা। সে স্থানীয় শিশুদের বিনামূল্যে
পড়ায়, রাত হলে উপবাস করে ধ্যান করে। তার পুজোর ধ্যান এত নিখুঁত, অনেকে বলে সে নাকি
মূর্তিকে নড়তে দেখেছে।
গ্রামের বৃদ্ধরা রাতের পর
রাত বলে,
“যখন সে জপ করে, তখন
মন্দির থেকে অদ্ভুত ধ্বনি আসে… রুদ্রাক্ষের মত শব্দ...”
কিন্তু সবকিছু পাল্টে যায়
এক রাতে—যখন হঠাৎ মন্দিরের দরজা খুলে দেখা যায়, মাটিতে লেখা একটা বাক্য—
“সে ফিরে আসবে। আর আগুনও।”
আদিত্য বুঝতে পারে—তার
পেছনের সময় থেমে থাকেনি। অতীতও নয়।
সেদিন রাতে শোবার সময়,
শিবের চরণে শুয়ে থাকা এক ধ্বস্তকণ্ঠে আদিত্য ফিসফিস করে বলেছিল—
“প্রভু, আমি প্রস্তুত…
আবার যদি পুরনো আগুন ফিরে আসে, তবে এবার আমি জ্বলতে রাজি।”
ঘরের বাইরে তখনও ঝড় বয়ে
যাচ্ছিল, আর মন্দিরের গায়ে ধাতব ঘণ্টা ধ্বনি হয়ে উঠছিল গা ছমছমে এক সুর।
(চলবে...)
Comments
Post a Comment