অ ন্ত রা লে (দ্বিতৃীয় খণ্ড) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

 
       

অ  ন্ত  রা  লে (প্রচ্ছদ - ডঃ অসিত কুমার মাইতি) 


ভিরাজ রায়, বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানাধিকারী একজন ছাএ। যার মেধাবীত্বের কারণে এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য মাএ ২১ বছর বয়সেই একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরির সুযোগ পেয়েযান। ছোটবেলায় দশম শ্রেণীতে একটি বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করত। তার পাশে একটি গার্লস স্কুল ছিল, ওখানকার একটি মেয়ে যে অভিরাজের জীবনসংগ্রামকে অনেক খানি এক যোদ্ধার মত বানিয়েছিল। তাকে, এক অদ্ভুত প্রবাদ শুনিয়েছিল মেয়েটি, "সূর্য এবং চাঁদ দুজনেই সমান, তাদের যখন যার সময় তখন সে আলো দেবেই।" গার্লস স্কুলের মেয়েগুলো একাদশ শ্রেণিতে অভিরাজদের স্কুলেই ভর্তি হল। ঐ মেয়েটির নাম অর্পূবা বিশ্বাস। 
রামলালপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। 
        একদল ছাত্র ছাত্রী বিদ্যালয় ছেড়ে বিদায় নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে, তারই সাথে আর দল নতুন ছাত্র ছাত্রীর দল বিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনা শুরু করে। সেভাবেই অপূর্বা, সোমা, স্বপ্না, আরও অন্যান্যরা আসে রামলালপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
       শিক্ষবর্ষ সময়মত শুরু হয়ে গেল। অভিরাজ বিজ্ঞান বিভাগে আর অপূর্বা ভর্তি হল কলা বিভাগে। একদিন স্কুল ছুটির পর উন্মত্ত পাগলের মত কালো মেঘ যেন আছড়ে পড়ল রামলালপুর এলাকায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল মুষুলধারে বৃষ্টি। সবাই বাড়ি যাওয়ার জন্য বাইরে চলে এসেছে, অনেকে আবার কিছুটা দূরে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু আবার সবাই হুড়মুড় করে স্কুলের মধ্যে চলে আসে। বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাস হতো নীচে আর কলা বিভাগের ক্লাস হতো উপরের তলায়। দিনই অপূর্বা আগে বেরিয়ে যাওয়ায় একটুখানি ভিজে গিয়েছিল, উপরে গিয়ে বারান্দায় চুল খুলে যেন বৃষ্টির সাথেই খুশিমুখে খেলা করছিল। এটা অভিরাজকে যেন খানিকটা অপূর্বার প্রতি আকর্ষণ করেছিল। অভিরাজ তো এক নিষ্পাপ শিশুর মতোই তার দিকে একনজরে তাকিয়ে ছিল, মনের মধ্যে একটা অন্য জগৎ সৃষ্টি করেছিল। এরই ফাঁকে কখন যে বৃষ্টি থেমে গেল তা সে বুঝতেই পারেনি। এরপর থেকেই অপূর্বাকে দেখবার জন্য নানান ফন্দি বের করতে চেষ্টা করে। অপূর্বাদের ক্লাস উপরে আর অভিরাজদের ক্লাস হত নীচে, তাই দেখা করার সুযোগ কম ছিল। এজন্য শুধুমাত্র প্রার্থনা আর টিফিনের ফাঁকেই সুযোগ ছিল। তাই সুযোগ সে ছেড়ে দেয় নি। কখনো কলা বিভাগের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার নামে, কখনো বা টিউশনের সময় জিজ্ঞাসা করার নামে এক ঝলক দেখতে, ছুটে যেত। অপূর্বা হয়তো বুঝতে পারত যে অভিরাজ তার জন্যই বারবার আসে, কিন্তু কোনোদিন কিছুই বলে নি। অভিরাজের লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার আর প্রয়োজন হয়নি। অভিরাজরা এক বয়স্ক শিক্ষক সমরেশ সান্যাল এর বাড়িতে ইংরেজি পড়তে যেত। একমাস পর ওখানেই ইংরেজি পড়তে ভর্তি হল অপূর্বা। অভিরাজ ভাবছিল, ভগবান যা করেন খুব ভালোই করেন। স্যার এর বাড়ির পেছনে একটা পেয়ারার গাছ ছিল আর তার নিচে একটা বসার জন্য বেঞ্চ ছিল। ওখানেই অভিরাজদের আড্ডা ছিল। ওরা ওখানে গিয়ে পেয়ারা পাড়ত নিজেরা খেত আর অন্যদেরও দিত।
         যতদিন যেতে থাকল, অভিরাজের ততই অপূর্বার প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থাকল। এইভাবে একবছর চলে গেল। সবাই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হল। একদিন বুকের মধ্যে কয়েকদিনের এই ভালোবাসার  প্রদীপের সলতে তে আগুন জ্বালল ; খুব সাহস করে অভিরাজ, অপূর্বাকে প্রস্তাব দিল এবং ওকে ভালো লাগার কথাও বলল কিছুক্ষণ পর অপূর্বা বলল, "আমি পরে ভেবে বলব" একদিন যায়, দুই দিন যায় এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ শেষ হতে চলল কিন্তু উওর না পেয়ে অভিরাজ একদিন অপূর্বাকে জিজ্ঞেস করল, 'কি রে কি ভাবলি, বল কিছু'।অপূর্বা বলল,"দেখ অভি আমি কখনোই ওসব ভাবিনি আর তোকে আমি কখনো নজরে দেখিনি। তাছাড়া তুই ক্লাসের ফার্স্ট বয় তুই যাকে চাইবি, সেই তোকে ভালোবাসবে। আমার থেকেও আরও অনেক আছে যারা দেখতে সুন্দর, শুধু আমিই কেন?

        আভির মনে কালো মেঘের স্তর স্থির হয়ে এল। কিছুক্ষণ পরে অভিও উওর দেয়, "আমি শুধু তোমাকেই চাই অন্য কাউকে নয়, আর তোমাকে কেন ভালোবাসি তা আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু এটা সত্যি যে আমি তোমায় খুব ভালবাসি, আর সারাজীবন এতটাই ভালোবেসে যাবো।" কিন্তু তারপরও উওর এল 'না' তখনও অভি আশা ছাড়েনি। সে সরাসরি বা কখনো অপূর্বার কাছের বান্ধবীদের থেকে অপূর্বার সম্পর্কে জানতে চাইতো।বারংবার যখন" না, জানি না" এরকম উওর আসত তখন অভি নানান ভাবে ধীরে ধীরে ধাক্কা পাচ্ছে আর নিজের সমস্ত কাজ থেকে বিরত থাকতে থাকতে অনেক পিছিয়ে পড়তে থাকল। এমনকি যেখানে সে নিয়মিত ছাএ ছিল, সেখানেও সে অনিয়মিত হয়ে গেল। ইংরেজি কোচিং যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, কি করবে ভাবেই নি। এভাবেই প্রায় ছয় মাস কেটে গেলে। এমন সময় সোমা এসে বলল অভি কাল সকালে ইংরেজি পড়তে যাস,  অপূর্বা তোকে কিছু বলবে বলছে। স্যার এর বাড়ির পেছনে পেয়ারা গাছের কাছে। ঠিক পরদিন সকালে যাওয়ার জন্য কেমন যেন অধৈর্য্য হয়ে গেল মনটা। বারবার ব্যাগ থেকে বই-খাতা বের করে, আবার গুছিয়ে রাখে। রাত জেগে জেগে ভাবতে থাকে কাল সকালে কেমন করে অপূর্বার সামনে যাব? সে' বা কি বলবে ? মনের মধ্যে খানিকটা আনন্দ এলেই আবারও সংকোচে ভাবে কাল আবার আমায় একেবারেই দূরে সরিয়ে দেবে না তো?  এই সব নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা অভিও বুঝতে পারল না।

        হঠাৎই  মা ডাকছে, আজ কি কোন কাজ নেই বাবু, তুমি একমনে ঘুমোচ্ছো? কোথায় ইংরেজি পড়তে যাওয়া হবে যে :৩০ বাজে তো। ওঠ বাবা। মায়ের ডাক শুনে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে সাইকেল নিয়ে দ্রুত চলে গেল। সমরেশ বাবুর বাড়ির সামনে সাইকেল রেখে, পেয়ারা গাছের কাছে দেখল অপূর্বা তারই জন্যে অপেক্ষা করছে। অভিরাজ ভাবছিল আমি কিছু বলব না, আগে বলবে ভেবেপাচ্ছিল না। এমন সময় অপূর্বা বলল,, অভি কেন জানি না, আমি তোকে যতবারই দূরে রাখবার চেষ্টা করেছি ঠিক ততবারই, কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট পেয়েছি। সত্যি বলতে কি 'আমি তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি।' আই লাভ ইউ টু মার্চ অভি'
কথাগুলো শোনার পর অভি মনের আনন্দে মেতে উঠেছিল। যেন আজ সে উড়বার জন্য প্রস্তুত। আজ তার সামনে সব যুদ্ধের সেই নায়ক। সেই আনন্দ, সেই উচ্ছ্বাস আর বর্ননা করা গেল না।

        একটা কাল বৈশাখীর প্রচন্ড ঝড়ের মতো ফাইনাল পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যায়। অভির জীবনে আবার একটা কালো মেঘেরস্তর ঘনীভূত হতে থাকে। কারণ পরীক্ষা শেষ হলো আর তার সাথে সাথেই টিউশনগুলোও আর অপূর্বার সাথে দেখা হবে না, কথাও হবে না। খুব মন কেমন করছে অভির বারবারই অপূর্বার কথা মনে পড়ছে।
        এরপর থেকে আর পড়াশোনায় মন নেই অনেকদিন। এরই পর একটা দিন বন্ধুরা ওর বাড়ির ফোন নং. জোগাড় করে আনলে, অভি ছুটে যায় গ্রামের একটা ফোন দোকানে। সেখান থেকে ফোন নং. ডায়েল করল। ফোনটা বেজে উঠল। অভিরাজ কি একটা ভেবেনিয়ে ফোনটা রেখে দিল। এরপর থেকে মাঝে মাঝে এস. টি. ডি বুথ থেকে অপূর্বার সাথে কথা বলতো। কখনো বা অন্য কোথাও ডেকে নিয়ে সেখানে দেখা হতো। এভাবে ধীরে ধীরে অভির খুব কাছে চলে আসে অপূর্বা। পরীক্ষা সামনে চলে আসায় অপূর্বার সাথে দেখা সাক্ষাত সব বন্ধ হলো। এভাবেই সময় গড়াতে গড়াতে পরীক্ষা আর মাএ তিন মাস বাকি ছিল। কিন্তু কই কিছুই তো পড়া শেষ হয়নি। কি পরীক্ষা দেব ভাবছিল। অপূর্বা অভিরাজ এর কাছে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে কেবল মাত্র ওকে একটা চমকপ্রদ উপহার দিতে বন্ধ থাকা সব পড়াগুলোকে মাএ তিন মাসেই শেষ করে পরীক্ষা স্কুলের প্রথম স্থানাধিকারী একজন ছাএ হয়ে গেল অভিরাজ। সবাই তাকে সম্বর্ধনা দিলো। কিন্তু সেরাটা ছিল অপূর্বার দেওয়া সম্বর্ধনাটি।
(চলবে...)

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি