দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ২) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি
পর্ব ২: মাটির চৌকিতে বসে স্বপ্ন বোনা
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরা সহজ ছিল না। মা ভোরবেলা অন্যের বাড়ি রান্না করে আসতেন, আর সনাতন সকালে গিয়ে মাঠে বীজ ছিটিয়ে আসত। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, যেখানে তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ—ছবি আঁকা।
কিন্তু এখন আর সময় নেই শুধু নিজের জন্য আঁকার। পেটে ভাত না থাকলে, তুলি তুলে আকাশ আঁকা যায় না। তাই একদিন সনাতন সিদ্ধান্ত নিল, “আমি শেখাব। যারা চায়, তাদের আঁকতে শেখাব।”
প্রথম ছাত্রী এল পাশের বাড়ির রেনু—মাত্র ছয় বছরের মেয়ে, কাগজে
গোল গোল দাগ কাটে, তারপর সেগুলোকে পাখির চোখ বানায়।
সনাতন তাকিয়ে হেসে বলে, “তুই পাখি আঁকিস না, তুই তো আকাশ আঁকিস!”
সেই শুরু। দিনে দিনে ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ৭… ছেলেমেয়েরা আসতে লাগল।
কেউ বলত—“আমরা স্কুলে যাই না স্যার”, কেউ বলত—“বই ভাল্লাগে না”, কিন্তু সনাতনের আঁকার
ক্লাসে তারা নীরবে তুলি চালাত।
প্রথমে উঠোনে হতো ক্লাস। বটগাছের ছায়ায় কাঁথা বিছিয়ে চলত চিত্রকলা।
তাদের টুল ছিল ইট, খাতা ছিল পুরনো খাতা, রঙ ছিল কাঠের বাক্সে রাখা কিশোর কাগজের চিত্রতুলির
গুঁড়ো।
একদিন এক ছাত্র বলল, “স্যার, আমাদের এই স্কুলটার নাম দেবেন
না?”
সনাতন থেমে গেল, তারপর মৃদু হেসে বলল,
“আলোক-আঁধারির মাঝেই তো আমাদের ছবি জন্মায়। তাহলে নাম হোক—‘দীপ্তি-তিমির
আলয়’। এই হবে আমাদের ঘর।”
সবাই উচ্ছ্বসিত। সাদা খাতা না থাকলে তারা কয়লা দিয়ে বাঁশবনে
ছবি আঁকত।
তারা লিখল: "আমরা আঁকি, তাই আমরা আছি।"
জীবনের আরেক ছায়া: দিদির হারানো রঙ
সনাতনের বড় বোন বেণী। পনেরো বছর বয়সে এক দূর্ঘটনায় তার পা ভেঙে
যায়, হাঁটতে পারে না ঠিকঠাক। সব সময় ঘরের কোণে বসে থাকত, কারো সঙ্গে কথা বলত না।
সনাতন একদিন তার হাতে একটা পুরনো তুলি গুঁজে দেয়। “তুই চুপচাপ বসে থাকিস কেন, দিদি? তোর মনটা আঁক।”
বেণী প্রথমে কিছু না বললেও, পরে একদিন দেখা গেল, কাগজে সে আঁকছে—একটা
গাছ, যার ডালগুলো ভাঙা কিন্তু পাতায় ভরা।
সেই ছিল তার প্রথম “সন্ধ্যা” নামক ছবি, যা পরে গ্রাম্য প্রদর্শনীতে
প্রশংসা পায়।
সনাতন বুঝতে পারে, শিল্প শুধু প্রকাশ নয়, মুক্তিও।
আলোকের নিচে ছায়ার শব্দ
গ্রামের মানুষ সবাই এই আঁকার ক্লাসকে তাচ্ছিল্য করত।
“এই সব চালাকি কাজ দিয়ে কি চলে?”
“বাচ্চাদের নষ্ট করছে।”
“ছবি আঁকা মানে তো খালি অলসপনা!”
কিন্তু সনাতনের চোখে অন্য কিছু। সে দেখত, যে ছেলে লেখাপড়ায়
অমনোযোগী, সে তুলিতে জীবন খুঁজে পায়। যে মেয়ে ক্লাসে মুখ খুলত না, সে পুকুর আঁকে, মাছ
আঁকে, নিজের দুঃখ আঁকে।
একদিন এক ছাত্রের বাবা এসে বলল, “স্যার, আমার ছেলে তো কিচ্ছু জানত না,
এখন বলছে গাছের ডালও কথা বলে! আপনি ওকে বদলে দিলেন।”
সনাতন মাথা নিচু করে হাসে। সে জানে, এই তার পথ। না নামকরা কলেজ,
না বিদেশি প্রদর্শনী—তার সফলতা এই ছোট্ট চোখে, যেখানে এক শিশুর হাতে রঙ আছে, আর মনের
মধ্যে গল্প আছে।
দীপ্তি-তিমির আলয় শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়ায়।
এক মাটির গৃহশিক্ষক, হাতে কালি, পায়ে কাদা আর মনে রঙ নিয়ে গড়ে তুলছেন এক নতুন পৃথিবী।
Comments
Post a Comment