দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ৩) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

 

পর্ব ৩: দেয়ালে দেয়ালে আলো আঁকা দিন

 

ধনীবাঁধ গ্রামে বসন্ত মানেই হালকা বাতাস আর কুসুমে ভরা গাছ। এমন এক বিকেলে, সনাতন তার ক্লাস শেষ করে যখন উঠছিল, এক মা এসে বললেন, “স্যার, পুজোর সময় না হয় মণ্ডপে কিছু আঁকিয়ে দেবেন? আপনি আর আপনার ছেলেমেয়েরা?”

সনাতন অবাক। এতদিন যে আঁকা ছিল উঠোনের কোণায়, সেটা এবার গ্রামের দুর্গাপুজোর মূল মণ্ডপে? 

সে একটুও না ভাবেই রাজি হয়। পরদিন থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। কুড়িজন ছাত্রছাত্রী, সাদা রঙের বালতি, পুরনো তুলির ঝুড়ি, আর দেয়াল—এ যেন এক বিশাল ক্যানভাস।

ছবির থিম ছিল “আলোকের আহ্বান”। একদিকে কুমোরের চাকা ঘোরে, মাটির মা আসেন। অন্যদিকে একজন বালক রাতের আকাশে হাতে প্রদীপ ধরে হাঁটে। ছবির মাঝখানে — “দীপ্তি-তিমির আলয়” লেখা কালো কালি দিয়ে। মানুষ প্রথমে অবাক, পরে মুগ্ধ। 

পুজোর সন্ধ্যায় এক বৃদ্ধ পণ্ডিত এসে বলেন, “ছবি দেখে মনে হয়, মাটির মধ্যে থেকেও আলো জ্বলে।

 

প্রথম প্রদর্শনী, প্রথম দুঃখ


সেই বছরই জেলা থেকে একটি NGO আয়োজিত ‘শিশু শিল্প প্রদর্শনী’-র খবর আসে। সনাতন নিজের ছাত্র জিতু, মল্লিকা, আর এক প্রতিবন্ধী বালিকা বর্ণালী-র ছবি পাঠান।

সারা জীবন এই প্রথম! গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে তাদের ছবি যাচ্ছে শহরে। ছাত্রদের চোখে তখন এক অন্য আলো, যেন সত্যিই তারা কিছু করছে।

কিন্তু ফলাফল আসে অপ্রত্যাশিত। 

শুধু জিতু-র ছবি নির্বাচিত হয়। মল্লিকা আর বর্ণালীর ছবি বাদ পড়ে। 

আরো কষ্টের বিষয়—জিতু শহরে গিয়ে নিজের শিক্ষক ও স্কুলের কথা না বলে বলে, “আমি নিজেই সব শিখেছি।”

সনাতন প্রথমে কিছু বলে না। কিন্তু রাতে মাটির উঠোনে বসে, মায়ের পাশে, তার চোখে জল আসে। 

মা বলে, “বাবা, রোদ পোহালে ছায়াও পড়ে। ছায়া যদি পেছন থেকে ছায়া দেয়, তবু সামনে রোদ থাকে, সেইটা ধরে রাখিস।”

এই দুঃখ, এই গ্লানিই হয়তো তাকে গড়তে শুরু করে এক অন্য মানুষে। তিনি বুঝে যান— “এই পথ একা, এই পথ কঠিন, এই পথেই আলো।”

 

 

ছোটদের কণ্ঠে বড় কথা


প্রদর্শনীর ফলাফলের পর পরই, স্কুলে কেউ কেউ আসা বন্ধ করে দেয়। 

গ্রামের কিছু লোক আবারও বলে, “না আছে সনদ, না ডিগ্রি! কারও ছবিই তো বাদ পড়ল।”

তখন হঠাৎ করেই তার এক ছাত্রী, মাত্র দশ বছরের বর্ণালী, যার এক পা কমজোর, তার খাতা বাড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি যদি হারি, আপনি কি আঁকানো বন্ধ করবেন?” 

সনাতন চমকে গেল। 

সে বর্ণালীর মাথায় হাত রাখে, আর বলে— “না রে মা। হারলে তবেই তো আঁকার দরকার হয়।”

এই বাক্য থেকেই আবার নতুন করে শুরু হয় স্কুলের ছন্দ।


মোড় ঘোরানো বার্তা

কিছুদিন পর এক অপরিচিত লোক এসে তার বাড়িতে হাজির। পরিচয় দেয়—গভীর চট্টোপাধ্যায়, শহরের একজন নাট্যকার। 

সে বলে— “আপনার ছাত্রদের আঁকা আমি পুজোর সময় দেখেছি। আপনি যদি রাজি থাকেন, আমি আপনাদের একটা ছোট প্রদর্শনীর সুযোগ দিতে পারি শহরে।”

সনাতনের মুখে তখন শব্দ নেই। 

তিন বছর ধরে যে স্বপ্ন সে একা বুনেছে, এখন সে স্বপ্নে ঢেউ উঠেছে।

 (চলবে...)

Comments

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি