দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ৪) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি
পর্ব ৪: শহরের পথে, গ্রামের আলো হাতে
গভীর চট্টোপাধ্যায়ের ফোনের পর সনাতন একদম নিশ্চিন্ত ছিল না। প্রথমবার শহরে, প্রদর্শনী, অচেনা লোকেরা—সব কিছুতেই একটা অস্বস্তি ছিল। একদিকে সে এতদিন গ্রামের আলো আঁকতে দেখেছে, অথচ আজ সেই আলো শহরের গাঢ় অন্ধকারে পড়বে কী? কিন্তু তিনি জানতেন, এ সুযোগ ছাড়া কখনোই বুঝতে পারবে না তার কাজ কোথায় গিয়ে থামে।
যত দিন গেছে, ততই সেই প্রদর্শনীর তারিখের কাছে পৌঁছে আসছিল।
সনাতন তার ছাত্রদের সঙ্গে একেবারে অন্যরকম এক উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছিল। যে শিল্পীরা
কখনো নিজেদের ছবি একসঙ্গে এঁকেও দেখেনি, তারা এখন একে অপরের ছবিতে নতুন করে প্রাণ দিচ্ছিল।
“আমরা দেখাবো কীভাবে একে অপরকে আলো দেয়। একে অপরকে আঁকে।”
শহরে প্রথম পদার্পণ
পরদিনই সনাতন তার ছাত্রদের নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলেন।
গ্রামের ছেলেমেয়েরা একেবারে নতুন শহরের পরিবেশে, তাদের চোখে কৌতূহল আর উত্তেজনা। শহরটা
ছিল বিশাল, যেন এক বিরাট দানব—ভিড়, গাড়ি, বিলবোর্ড—সব কিছুতেই অচেনা।
“এই শহরকে কি আমার ছবি দেখে চিনতে পারব?” সনাতন মনে মনে ভাবছিল।
তবে যখন তারা প্রদর্শনীর স্থান, এক আধুনিক গ্যালারির সামনে
পৌঁছাল, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এখানে প্রতিটি ছবির পাশে নাম, দাম—আর সেই ছবির
সৃষ্টি যে হাতগুলোর, সেই শিশুরা দাঁড়িয়ে। একেবারে নতুন দৃষ্টিতে তাদের কাজকে মূল্যায়ন
হতে দেখে, সনাতন একটা গভীর অনুভব করল—এই শহরের সমালোচনা আর গ্রহণের মাঝে তার ছাত্রদের
ছবি যেন নতুন পথ খুঁজে পায়।
প্রথম দিন প্রদর্শনী শুরু হলো। মানুষ আসতে লাগল। অদ্ভুত কৌতূহল
ছিল সবার চোখে, গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কি সত্যিই শিল্পী হতে পারে?
অথচ তাদের ছবি সত্যিই শহরের সবার মন জয় করতে শুরু করেছিল।
প্রথম বড়ো প্রশংসা
পরদিন সকালে এক নামকরা শিল্পী, রঞ্জন মিত্র, সনাতনের ছবি দেখল।
সে এসে বলল,
“আপনার ছেলেমেয়েদের ছবিগুলো একেবারে ভিন্ন ধরনের। এটা আসলে নতুন এক ধারা। আপনার ছাত্রদের, আপনি কি জানেন, এগুলো প্রথাগত শৈলীর বাইরে।”
সনাতনের বুকটা একটু বেশি দ্রুত ঠক ঠক করে। তাকে জানানো হলো, এমন এক প্রদর্শনীর আয়োজন হতে যাচ্ছে, যেখানে তিনি শহরের বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে একসঙ্গে যোগ দেবেন।
এটা ছিল তার জীবনের প্রথম বড়ো সাফল্য, আর সেই সাফল্যকেই জীবনের
সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে পরিণত করতে কিছু সময় লাগল না। সনাতন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার
সিদ্ধান্ত নিল, তার প্রিয় গ্রামের স্কুল, তার ছাত্রদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। শহরের
আলো, সবার প্রশংসা—তার কাছে সব কিছুই ছিল এক টানেল, যে টানেলে সৃষ্টির অন্ধকার ছিল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে
যখন সে ধনীবাঁধে ফিরল, তখন তার মন ভারী হয়ে এসেছিল। অনেক কিছু
শিখেছিল, কিন্তু জীবন তাকে আরো অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। শহরে কাচের দেয়ালে আঁকা ছবির
মতো কেমন যেন শূন্যতা লাগছিল।
তবে তার ছাত্ররা, যারা তাকে দিয়ে ছবি আঁকত, তারা তখন সারা গ্রাম
জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। একে একে সে দেখতে পেল—ছবির মত প্রাণ পেয়েছে গ্রামের প্রতিটি মানুষের
জীবনে।
বর্ণালী, মল্লিকা, জিতু—তাদের ছবি গ্রামের প্রতিটি দেয়ালে যেন নতুন রং ছড়িয়ে দিল।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি—এখন সনাতন জানত, শহরের বালুকাবেলা আর গ্রামের
মাটির ঘর—এই দুই জায়গাতেই শিল্প জন্মায়। একে অপরকে প্রভাবিত করে, একে অপরকে ঘুরিয়ে
দেয়, যে কখনও ভাবেনি, সে একটি শিল্পী হতে পারে।
শেষ পর্যায়ে সনাতনের ভাবনা
সনাতন অনেক কিছু শিখেছে। শহরের উজ্জ্বলতা, তার ছাত্রদের নতুন রং এবং নতুন ছবি, তার নিজস্ব জীবনের বাঁক—সবকিছু মিলিয়ে তাকে একটা নতুন চিন্তায় নিয়ে এসেছে। তার আঁকা ছবি, তার ছাত্রদের কাজ—এগুলো কোথাও এসে মিলেছে। সনাতন এবার জানে, “শিল্প শুধুই ছবি আঁকা নয়, এটা হলো একটি ভাষা, যেখানে প্রত্যেক শিশুর কণ্ঠ থাকে। এই কণ্ঠ শুধু রং দিয়ে ফুটে ওঠে।”
(চলবে...)
Comments
Post a Comment