দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ৫) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি






পর্ব ৫: নতুন দিগন্তে দীপ্তি

 

একবার শহর দেখে, সনাতন আবার গ্রামে ফিরে আসলে, তাঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শহরের আলো, বড় বড় শহরের প্রদর্শনী, প্রচুর প্রশংসা—এই সব কিছুই তাকে ভাবতে শেখায়। কিন্তু সত্যি বলতে, সে জানত যে, গ্রামের মাটির সাথে তার সম্পর্ক অনেক গভীর। সেখানেই তার মূল শক্তি, তার শক্তি ছিল তার ছাত্রদের মাঝে।

 

যতদিন সে শহরে ছিল, ততদিন তার মনে গভীর ভাবে একটা প্রশ্ন উকি দিয়ে যাচ্ছিল— “কীভাবে আমি আমার স্কুলটাকে আরও বড়ো করে তুলতে পারি?”

 

ধনীবাঁধে ফিরে, সনাতন তখন থেকেই তার নতুন পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করল। সবচেয়ে প্রথম কাজ ছিল— স্কুলের নামের পরিবর্তন। “দীপ্তি-তিমির আলয়” তার মনের কাছে এক বিশেষ অর্থ নিয়ে এসেছিল। তার ছাত্রদের মাঝে যে আশার আলো ছিল, সেটাই সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এত দিন ধরে গ্রামের সীমানার মধ্যে সে যেটি প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা এবার আরও বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।


নতুন পথের শুরু


একদিন দুপুরে, সনাতন তার ছাত্রদের বলল— 

“আমরা এবার আমাদের স্কুলটাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাব। এটা আর শুধু আঁকার স্কুল নয়, আমাদের শিক্ষা হবে এক নতুন পথের আলো। এখানে শুধু ছবি নয়, জীবনটা শেখানো হবে। যখন আমরা ছবি আঁকি, আমরা আমাদের পৃথিবীটা আরও সুন্দর করে দেখতে শিখি। পৃথিবী শুধু কাগজে আঁকা ছবিই নয়, এটা আমাদের জীবনের ছবি।”

 

প্রথমে সবাই হালকা সন্দিহান ছিল, তবে সনাতনের দৃঢ়তা আর উৎসাহ তাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। 

সনাতন ভেবেছিল—আমাদের ছাত্ররা শুধু আঁকা শেখে না, তারা বিশ্বকে অন্যভাবে দেখতে শেখে। এই শিল্প শুধু একে অপরকে বোঝার মাধ্যম নয়, আমাদের আধ্যাত্মিকতাও যেন একইভাবে একে অপরকে সমর্থন করে।

 

এরপর শুরু হয় বড়ো পরিবর্তন। সেনা বাহিনীর মতো একে একে ছাত্ররা সবাই স্কুলে আসে, এবং নতুন ক্যানভাসে কাজ করতে শুরু করে। একে একে তারা নিজেদের আঁকা ছবি শহরের স্কুল, শিশুদের ক্লাব, সরকারি ভবনে প্রদর্শন করতে নিয়ে যেতে শুরু করল।

 

কর্মশালা এবং সেমিনার


একদিন, সনাতন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষকদের কাছে একটি সেমিনার আয়োজন করার পরিকল্পনা নেয়। এটা ছিল তার একটা স্বপ্ন। 

“শিল্পের মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব”—এই বিষয়টি নিয়ে সেমিনারে সনাতন তাঁর ছাত্রদের সৃষ্টির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।


“আমাদের ক্লাস শুধু আঁকা শেখা নয়, এখানে একটি জীবনপ্রবাহের শিক্ষা দেওয়া হয়। যখন শিশুরা ছবি আঁকে, তারা কেবল রঙই মেশায় না, মনের অনুভূতিও সেখানে স্থান পায়।”

সেমিনার শেষে, সনাতনের শিক্ষক বন্ধুরা বলল, “এটা সত্যিই এক নতুন আন্দোলন হতে যাচ্ছে। আমরা যদি স্কুলগুলোতে এমন কর্মশালা আয়োজন করি, তাহলে হয়তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে।”

 

প্রথম পুরস্কার, নতুন দৃষ্টি


অবশেষে, সনাতনের স্কুল “দীপ্তি-তিমির আলয়” তার প্রথম বড়ো পুরস্কার পায়। রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে, একটি বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। সনাতন, তার ছাত্রদের সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সেই পুরস্কার গ্রহণ করল। কিন্তু সনাতন জানত, এই সম্মান শুধু তার একার নয়—এটা তার ছাত্রদের, তাদের মায়ের, বাবার, গ্রামবাসীদের।

 

অবশেষে, দীপ্তি-তিমির আলয় শুধু একটি স্কুল হয়ে রইল না, এটি হয়ে উঠল এক আন্দোলন, যেখানে শিল্প, শিক্ষা, এবং মানবিকতা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে থাকে।

 

নতুন স্বপ্ন, নতুন আশার আলো


আজও সনাতন স্কুলের ক্লাসে বসে থাকে। আবারও তার ছাত্ররা নতুন ছবি আঁকে, নতুন গল্প লেখে, নতুন দিগন্ত দেখে। তার চোখে এক নতুন চমক, সে জানে—এখন তার স্কুল শুধু গ্রামে নয়, পুরো অঞ্চলে নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে।


সনাতন কখনো ভাবেনি, একজন গৃহশিক্ষক হিসেবে তার এই পথচলা একদিন এত বড়ো আন্দোলন হয়ে উঠবে। কিন্তু আজ সে জানে—শিল্প জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা, যেখানে আত্মবিশ্বাস, শিক্ষা, মানবতা এবং ভালবাসা সব কিছু এক হয়ে গড়ে ওঠে।


সে জানে—এখন তার পথ অনেক বড়ো, অনেক সুন্দর, এবং সেই পথ অবিরত চলতে চলতে একদিন সত্যিই চিরকাল টিকে যাবে। 

“আমরা আঁকি, তাই আমরা আছি।” 

(চলবে...)

Comments

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি