দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ৬) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি



 পর্ব ৬: জীবনের চিরন্তন পথ

  

দীপ্তি-তিমির আলয় এখন আর একটি ছোট্ট স্কুল নয়। ধনীবাঁধ গ্রামের এক কোণে, যেখানে আগে শুধুমাত্র পাথরের গন্ধ আর মাটির কণা ছিল, সেখানে আজ হালকা রোদে ভরে গেছে। সনাতন ঘোষের স্কুল এখন আঞ্চলিক পুরস্কার পাচ্ছে, শহর জুড়ে তার ছাত্রদের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। কিন্তু সনাতন জানে, এই সাফল্য আর বাহবা তার একার নয়—এটা তার ছাত্রদের, তাদের পরিবার, আর গ্রামের অব্যক্ত প্রার্থনার ফল।

 

তবে সনাতন কখনো খুব বড়ো কিছু চায়নি। সে চেয়েছিল তার ছাত্ররা বুঝুক—শিল্প শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়, এটা জীবনের এক বিশেষ ভাষা। সেদিন যখন তার ছাত্ররা স্কুলের নতুন কাঠামো দেখতে পায়, তার চোখে সেই একই দীপ্তি, সেই একই ঝলমলে আশার আভা ছিল, যা কখনো মাটির পথে শুরু হয়েছিল।

 

 সত্যিকারের পরিণতি

  

এখন, ধনীবাঁধ গ্রামের চেহারা বদলে গেছে। আগের সেই ক্ষুদ্র একাডেমিক স্কুলটি শহরের বড় বড় কলেজের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। এখানে শিল্পের শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মশালা, আলোচনা সভা, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সনাতন ঘোষ, যিনি একদিন শুধুমাত্র একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, আজ তাঁর স্কুল হয়ে উঠেছে সমাজে আলো ছড়ানোর এক বড়ো উৎস। তার ছাত্ররা শুধু শিল্পী নয়, তারা এখন সমাজের সচেতন নাগরিক, যারা সমাজকে তাদের ছবির মাধ্যমে নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছে।

 

অবশেষে, সনাতন নিজেই উপলব্ধি করতে শুরু করে—তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাজ, আসলে তার ছাত্রদের মধ্যে একটি নতুন বিশ্বাস, সাহস এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে সফল হওয়া। 

“আমরা আঁকি, তাই আমরা আছি”—এই বাক্যটি এখন শুধু একটি কথা নয়, এটি হয়ে উঠেছে তার জীবনের মূল মন্ত্র।


প্রথম পরিণতি—গড়েছে নতুন পথ


তবে সনাতনের জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরিণতি আসে তখন, যখন তার স্কুলকে একজন সরকারী কর্মকর্তা সরাসরি প্রশংসা করে। 

“এই স্কুল শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। এখানে যা শেখানো হয়, তা জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখায়।”

 

একদিন, সনাতন এক বইয়ের দোকানে গিয়ে তার নিজের লেখা একটি ছোট বই দেখলেন—“শিল্পের চোখে জীবন”। এটি ছিল তার শিক্ষাদানের দর্শন, যা শহর এবং গ্রামে এক সঙ্গে বিক্রি হচ্ছিল। সনাতন জানত—তার কাজ আর শিল্পের একে অপরকে সমর্থন করে চলার জার্নি আজ এক নতুন জায়গায় পৌঁছে গেছে।


শেষ পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস


আজ, সনাতন তার স্কুলের এক কোণায় বসে, মাটির মূর্তি তৈরি করতে করতে ভাবে—শিল্প আসলে এক মহা অভ্যন্তরীণ যাত্রা। একদিন, নিজের শিল্পের সঙ্গেই সনাতন তীব্র ভাবে মুখোমুখি হয়েছিল—যখন তার ছাত্রদের প্রথম ব্যর্থতা এবং তাঁর নিজের অক্ষমতা তাকে আঘাত করেছিল। তবে আজ সে জানে, সেই ব্যর্থতাই তাকে শক্তিশালী করেছে, এবং সে শেখার মাধ্যমে নিজেকে পূর্ণ করেছে।


ছোট ছোট ছাত্রদের ছবি এখন শুধু দেয়ালে নয়, তাদের ভবিষ্যতের আকাশেও ছড়িয়ে যাচ্ছে। সনাতন ঘোষের নাম এখন আঞ্চলিক বিশিষ্টতায় পরিণত হয়েছে। তবে তিনি জানেন, তার সবচেয়ে বড়ো অর্জন সেই শিশুদের মধ্যে যেটা সৃষ্টি হয়েছে—আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন দেখার শক্তি।


তিনিই তো সেই শিক্ষক, যে তাদের আঁকতে শেখাল না শুধুমাত্র ছবির মাধ্যমে, বরং জীবনের মাধ্যমে। আজ, তার ছাত্ররা শুধু শিল্পী নয়—তারা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক। তারা জানে, ছবি শুধু সুন্দর দেখতে নয়, জীবনটাকেও সুন্দর করে তোলে।

 

শিল্পের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক

 

সনাতন ঘোষের জীবন কাহিনী আসলে একটি শিল্পের সৃষ্টি, যেখানে ছবির মাধুর্য আর জীবনের কঠিন বাস্তবতা একত্রিত হয়ে। তার স্কুল আজও ছোট ছোট শিল্পী তৈরি করে, যারা আর একদিন বড়ো হয়ে দুনিয়া পালটে দেবে।


তবে সনাতন জানে, তার সবচেয়ে বড়ো সৃষ্টিই ছিল—এই স্কুলের শিক্ষা ও সংস্কৃতি তৈরি করা। শিক্ষায়, জীবনের প্রতিটি কোণে, শিল্পের আলো পৌঁছে দেওয়া। এটি তার জীবনের সার্থকতা—শিল্পকে শুধু ক্যানভাসে নয়, মানুষের মনেও আঁকা।

 

চিরকালীন অধ্যায়


আজও সনাতন নিয়মিত তার ছাত্রদের সঙ্গে বসে, তাদের আঁকা ছবিগুলো দেখতে এবং তাদের সঙ্গে গল্প করতে। তবে সনাতন জানে—এই কল্পনাশক্তি, এই জীবন দর্শন, এবং এই চিরন্তন আশার আলো তার ছাত্রদের সঙ্গে তৈরি হয়েছে, যা একদিন গ্রাম, শহর, আর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। 

“শিল্প কখনো শেষ হয় না। এটি একটি চিরন্তন যাত্রা—যেখানে আমাদের গল্প, আমাদের ছবিগুলো, চিরকাল রয়ে যায়।”


শেষ! তবুও শেষ হল কি?

ইতি...  


 

Comments

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি