সেই গন্ধটা আজও আছে (পর্ব - ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি


সেই গন্ধটা আজও আছে


    জকের শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে এই পাড়াগাঁ। অচেনা শবর টাউনেরই একটা কোলে রয়েছে। জায়গাটা  অজ পাড়াগাঁ। রাস্তার দুপাশে জঙ্গলের জটলা আর চারিপাশের বাচামরা লতাপাতার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পা গুলোর স্পর্শে ধূলি-বালির কণাগুলো আবার তাদের আনন্দের জীবন গতি ফিরে পায়। স্বাচ্ছন্দে আবারও বাতাসে ভেসে বেড়াতে চেষ্টা করেছে। প্রথম প্রথম পাড়াগাঁ বলেই মনে হয়েছিল। ধীরে ধীরে যত এগোচ্ছি এই ধারানাটা নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছে। গাছ পাতার আড়ালে- আবডালে দ্বিতল- ত্বি-তল বাড়িগুলো  আমার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। সেখানেই রয়েছে দু-একটা টিউবওয়েল যেগুলো ব্যবহার না হওয়ায়, নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে, আর ঘরগুলির ভাঙ্গা সার্সি, লোহার পাইপ দেখে মনেই হবেনা সেখানে আগে একটা পাড়াগাঁ ছিল। দু একটা ভাঙ্গা টিনের চালা, যেগুলো সক্ত-পোক্ত কাঁচা ইট আর টালির বাড়ি ছিল,তারা আজ নিজেদের কঙ্কালসার পাঁজর নিয়ে কোনমতে নিজের এলাকাটাকে টিকিয়ে রেখেছে।দু-পা গেলেই একটা বিসাল প্রশস্থ নর্দমা, তার দুপাশ সুন্দর মোজাইক করাছিল। আজ তারও করুন অবস্থা, গলাভর্তি শ্যাওলা তাঁরই মধ্যে দুএকটা বাচ্চা ব্যাঙ লাফালাফি করছে।

নর্দমার ওপারে লতা পাতার মধ্যে একটা শিব মন্দিরের অংশ দেখা যাচ্ছে ইচ্ছে হল একবার ঘুরে আসি। আর রাস্তার ওপর শুকনো লাল-হলুদ পাতার আনাগোনায় তাকে কানাডার কোন একটা লেন বলেই মনে হচ্ছিল। নর্দমার ওপর আধো-আধো ভাঙ্গা একটা লোহার সাঁকো। মনে মনে ভাবছিলাম, সাঁকোতে উঠে যদি এই নর্দমাতে পড়ি। তবে হাজার ডাকলেও কেউ আমার ডাক শুনতে পাবে না এ চত্বরে, তখন অকালেই প্রাণ যাবে। মনটা হতাশার কুয়াশায় ঢাকতে থাকে।

মনে মনে ফিরে যাওয়ার সিধান্ত নিলাম।

হঠাৎ বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও! ওহ… মা মরে গেলাম। আমি স্তম্ভিত হলাম আর পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম একটা লালচে-কালো, মাঝে মধ্যে ছেঁড়া শাড়িতে চোখ দুটো তার পুরো হরিণ নয়না, পাগুলো তার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। চোখে-মুখে কেমন যেন ভয়-আতঙ্কের ছাপ, চাহনি ভরা তীব্র ঈর্শা।

সাঁকোর ওপর দিয়েই ছুটে এল তারপর আমাকে দেখে আমার পেছনে আশ্রয় নিল। তার পেছন পেছন কয়েকটা রোগা লিকলিকে কুকুর, শরীরে এতটুকুও মাংস নেই বুকের পাঁজর ঠেলে বেরিয়ে এসেছে আর চোখগুলি ড্যাব ড্যাব করতে করতে সামনে বেরিয়ে আসছে। হিংস্র জন্তুর মতো দাঁত জিভ থেকে লালা ঝরছে অনবরত, ওই মেয়েটিকে তাড়া করছিল। আমি পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাথর আর গাছের ডাল ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিলাম।

          মেয়েটি সুর মাখানো গলায় বলল, “আপনি অন্য সবার থেকে আলাদা। আপনি খুব ভালো মানুষ।” অচেনা মেয়েটার কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। মনে মনে ভাবলাম “সবার থেকে আলাদা, ভালো মানুষ’ এ সবের মানেটাই বা কী হতে পারে?

          যাই হোক গে, অতশত ভেবে লাভ কী? বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। এমন অচেনা স্থানে টিউবকলগুলোও মজে গেছে তাই ওকে বলে কয়ে যদি কোন রকম কোন ব্যবস্থা করা যায়। তার থেকেও বড় ব্যাপার একটাই, এই অচিনপুরীতে বর্তমানে ওই আমার সঙ্গী এবং এখানকার বাসিন্দা বলেই মনে হচ্ছে। ওর থেকে যদি এই সুপ্ত পুরীর ইতিবৃতান্ত জানা যায় তবে আমার আকাঙ্খাও পূরণ হবে।

          আমি পেছন ফিরে বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই মেয়েটি বলল,“আপনাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জল খাবেন? আসুন আমার বাড়িতে আসুন।” 

(চলবে...)

Comments

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি