সেই গন্ধটা আজও আছে (পর্ব - ২) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি
হ্যাঁ! হ্যাঁ! নিশ্চই। আমরা সাঁকো পেরিয়ে সামনে বাড়িটাতে ঢুকলাম। এই একজন প্রানী ছাড়া আর কেউই এই বাড়িতে থাকে না। টিনের চালা নষ্ট হয়ে মাঝে মাঝে ফুঁটো হয়ে গেছে। বাড়ির দেওয়ালে ঝুল-কালি, যেন কয়েকদিন হল পরিষ্কার করা হয়নি। কয়েকটি বই-খাতা টেবিলের উপর সুন্দর করে সাজানো-গোছানো, গুটি কয়েক শাড়ি-চুড়িদার আর শালোয়ার কামিজ আলনায় পরিপাটি করে রাখা আছে।
মেয়েটি আমার মুখের কাছে জল আর সরবতের গ্লাস দুটোই ধরল। আমিও আর কোনো দ্বিধা না করেই দু চুমুকেই শেষ করলাম। “আচ্ছা বোন তুমি এই ধ্বংসপুরীতে একাই রয়েছ। বাকি সব কোথায় গেল? আর তোমার বাড়ির লোকজনই বা কোথায়? মেয়েটি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
আমার বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই ছিল। এমনকি এই এলাকাতে লোকজনের বিশাল সমাগম ছিল, প্রত্যেক বাড়ির মা-মেয়ে-বৌদিরা প্রতি সোমবার এই শিব মন্দিরে পুজো দিতে আসত, আজ থেকে নয় বছর আগেই এই গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। আর তার জন্য আমার বাড়ির লোকেরাই দায়ী।
মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাদাভাই একটু বসো।' তারপর ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল আর একটা পেতলের থালায় গুড় আর রুটি নিয়ে এগিয়ে আসছে বাম -হাতে একটা জলের মগ, মনে আমার তখন পুরো ঘটনাটা জানার তীব্র আকাঙ্খায় ব্যাকুল হয়ে রয়েছে। কাছে এসে বলল, দাদা নাও খেতে শুরু করো, অনেকক্ষন এসেছ কিছুই খাওয়া হয়নি, মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কিন্তু আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে এই ধ্বংস পুরীর ঘটনায় তোমার বাবা-মা দায়ী? মেয়েটি আলতো হাসি দিয়ে বলল,' বলছি বলছি আগে খেতে তো শুরু করো। তবেইতো বলব নয়তো না, বলেই আমার পাশে বশে চট করে একটুকরো রুটি ছিঁড়ে গুড় মাখিয়ে আমার মুখে গুঁজে দিল। তারপর নিজেও খেতে থাকল আবার বলতে শুরু করল, আধো ভাঙা কণ্ঠে, বলল, "আমার এক দিদি ছিল নাম সান্তনা রায়। কলেজে 2nd Year-এ পড়তে পড়তে সুরঞ্জন মুখার্জীর সাথে আলাপ হয় একটা ক্যাম্পাসিং-এ। দিদির ব্রেন খুব ভালো ছোট বেলা থেকেই। আমাদের দাদা সোমনাথ দুবাই-তে একটা কোম্পানির সেন্টার ম্যানেজার ছিলেন, আমাদের দুই বোনের যত আদর-আবদার তার কাছেই করতাম মোবাইলের মাধ্যমে তারপর দাদা বাবা-মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলত।
আমার বাবা- এখানকার প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মা ছোটদের স্কুলের দিদিমনি ছিলেন। আমি দূরে একটা মেষে থেকে পড়াশুনা করতাম। দিদির ইচ্ছা ছিল ওই ক্যাম্পাসিং-এ পাশ করে একটা চাকরী পাওয়া এটা যে সবাইকে বলেছিল, সুরঞ্জন দা আমার দিদির পাশের প্যাক্টিক্যাল সিটটা পেয়েছিল। ওই দিন দিদি একটা ভুল রি-এজেন্ট মেশাতে পরীক্ষাটা ব্যর্থ হয়ে যায়, মিই তখন সময়টাও শেষ হয়ে এসেছে। দিদি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল আর পরীক্ষক আসছেন এমন সময় দিদি হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল মাথা নীচু করে। তারপর হঠাৎই পরীক্ষক বলছেন, 'এত বড় ছেলে হয়েছ কোথায় কোন রি-এজেন্টটা মেশাতে হয় সেটাই জানো না। তুমি এই ক্যাম্পাসিং-এ বাতিল হলে। পরীক্ষক দিদিকে বলছেন, কী ব্যাপার সান্ত্বনা তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? তোমার পরীক্ষা নিখুত আর বেশ সুন্দর হয়েছে। এই ক্যাম্পাসিং-এ Best of five-এর মধ্যে তুমিও রয়েছ।'
দিদি ক্যাম্পাসিং-এর Viva-test-এও পাশ কাল কিন্তু যে Job offer এসেছিল সেটা গ্রহন করল না, শুধু বলল, আমার এখনও অনেক জানার বাকী আছে, অনেক শিখতে হবে। তারপর সেখান থেকে চলে এল। পরদিন কলেজে গিয়ে সুভাষের হাতে সুরঞ্জনদাকে কলেজ ক্যান্টিন-এ দেখা করতে বলে। তারা ক্যান্টিন-এ দেখাও করে। সেখানে দিদি সুরঞ্জন দাদা-কে বলে তুমি আমার ভুলটা নিজে নিয়ে তোমার ভালো- নিখুঁত পরীক্ষাটা আমায় দিয়ে দিলে কেন? 'কয়েকটা দিন আগে তুমি বলছিলে না তোমার বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ চলছে, ক্যাম্পাশিং-এ চাকরীটা নেবেই, তাহলে এমনটা করলে কেন, উত্তরে সুরঞ্জন দা শুধু বলেছিল, 'তোমারও তো ইচ্ছে ছিল এটাই, আর আমি কখনও কারও দুঃখকে দেখতে পারিনা, সে আমার যতোই দুঃখ-কষ্ট হোক আমি তা পূরণের চেষ্টা করি। সে আমার চেনা-জানা কেউ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আসলে কী জান সান্তনা আমি মনে করি আমার সামান্য দুঃখ বা কষ্ট সহ্যতে যদি কেউ সত্যিই সুখ পায় তবে সেটাই আমার বড় প্রাপ্তি।'
এভাবে ধীরে ধীরে ধীরে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়, দিদি ভুল করল, এটা দাদাকে জানাতে পারেনি। কিন্তু 3rd Year শেষের পরীক্ষার পূর্বে দিদি সুরঞ্জন বিয়ের প্রস্তাব আনতে বলল সুরঞ্জনদার বাড়ি থেকে,
একদিন সকাল ৮টা নাগাদ সুরঞ্জনদা ও তার বাবা-মা আমাদের বাড়িতে হাজির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবা প্রথমে থতমত খেয়ে যায়। তারপর তাদের বসতে দিয়ে দিদিকে চা আনতে বলে। দিদি বলল,' এত চা কী হবে? কে এসেছে?' বাবা বলল, 'তোকে দেখতে এসেছে। দিদি চা এনে সবাইকে দিল, বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল; মেয়েকে আপনাদের যদি শেনো জিজ্ঞাসা থাকে, তবে করতে পারেন। 'সুরঞ্জনদার বাবা মুচকি হেসে বলল, ছেলের যখন পছন্দ তবে আর প্রশ্ন কেন, দিদি তখনও ব্যাপারটা দাদাকে জানাতে পারেনি। তারপর ঘরে ঢুকেই ঘনঘন দাদাকে ফোন করেই চলেছে প্রায় আধ ঘন্টা পর দাদা ফোনটা তুলল, বলল কীরে খুকী হয়েছে টা কী, এতক্ষন ফোন করছিস। আগেতো কখনও এতবার ফোন করিসনি দাদা, দিদিকে 'খুকী' আর আমাকে 'মুন্নি' বলে ডাকত, দিদি সমস্ত ঘটনা দাদাকে বুঝিয়ে বলল, আরও বলল বাবাকে যাতে বুঝিয়ে বলে। দাদা বলল, “আরে খুকী তুই তোর মনের রাজকুমারকেই পাবি আমি বাবাকে আজই সব বুঝিয়ে বলব, এখন রাখ অফিসের অনেক কাজ রয়েছে।”
দিদি দরজার আড়াল থেকে শুনল, “বাবা বলছে ঠিক আছে। সম্বন্ধ পাকা, ছেলে-মেয়ে তাদের কোর্স পূরণ করুক নিজেদের পায়ে দাঁড়ালেই বিয়ে পাক্কা।”দেখতে দেখতে চার বছর পর সুরঞ্জন দা একটা সহকারী ম্যানেজারের পদ পেল আর তার দু-মাসের মধ্যেই দিদি এখানকার হাইস্কুলের রসায়নের ম্যাডাম হয়ে গেল, এবার বাবার কথা রাখার সময়। তবুও দু'বছর চলে যায় বিয়ের নাম গন্ধ পাওয়া গেল না, হঠাৎই দিদি অসুস্থ হয়ে পড়ল ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলা ডাক্তার জানালেন দিদি 'মা' হতে চলেছে।
বাবা কিছু না বলে, ডাক্তারের ফি দিয়ে দিদিকে বাড়ি নিয়ে কে এলেন, পথে শুধু বলেছিলেন ভয় করিনা মা ওই ছেলের সাথেই তোর বিয়ে খুব শীঘ্রই দেব,
(চলবে...)
Comments
Post a Comment