সেই গন্ধটা আজও আছে (পর্ব - ৩) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি
দিদিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, বাবা টলিওয়ালাকে টাকা দিয়ে বাড়িতে এসে কত কী হিসাব করে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলেন। মা বাড়িতে বাচ্চাদের টিউশান পড়াত, বাচ্চারা এসে পড়ায় তাদেরকে মা পড়াচ্ছিলেন। দিদি ফোন করে ব্যাপারটা সুরঞ্জন দাকে জানায়, কিছুক্ষণের মধ্যে বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে ফোনটা কেটে দেয় দিদি। বাবা-মাকে কী একটা বলল, তারপর বাচ্চাগুলোকে ছুটি করে দেয় বাচ্চারা যাওয়ার পর বাবা দিদিকে বাইরে এনে কিছু না বলেই মায়ের হাত থেকে বেতটা নিয়ে তীব্র প্রহার করতে থাকে। আর মা দিদির বই-খাতা, জামা-কাপড় টেনে এনে এই নর্দমায় ফেলতে থাকে। হাতের কাছে যেটাই পেল তাই দিয়ে দিদিকে প্রচন্ড প্রহার করল, প্রহারের চোটে দিদির চোখের ওপর, কপাল, নাক, মুখ ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে, টানাটানিতে শাড়িটাও ছিঁড়ে গেছিল। বাবা-মা ওদিন দিদির প্রতি এতটা নিষ্ঠুরতা দেখাল যে, শেষ পর্যন্ত বাবা দিদির বুকে লাথি মেরে এই নর্দমায় ফেলে দেয়। আর বলেছিল, ‘এই মেয়ে আমার চাইনা।’
আমিতো আঁতকে উঠি।
মেয়েটি বলে “আর বললে হবে, তার ভাগ্যের দোষ ছিল। বাবা-মায়ের ভয়ে এই গ্রামে এতগুলো লোক থাকতেও কেউ সাহস করে বাবাকে বাধা দিতে পারল না, এমনকি দিদিতো এই একগলা নরম থক্-থকে কাদার মতো আবর্জনার মুখ গুঁজেই মারা যেত, কিন্তু...
মেয়েটি একটুক্ষন থেমে গেল, আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম কিন্তু কী হল তারপর....
আবার মেয়েটি বলতে থাকল, দিদি তো বেঁচে গেছিল, কারন ওই যে বট গাছটা দেখছেন, ওর একটা শেকড় নর্দমার দেওয়াল ফুঁড়ে অর্ধেকটারও বেশি চলে গেছে, দিদি তার ওপর এক হাত রেখে অন্য হাত তুলে সবাইকে বলছে" আমাকে বাঁচাও, ও দাদু, ও কাকু, ও বৌদি আমাকে এখান থেকে তুলে নাও, আমার কিছু চাইনা, আমাকে শুধু বাঁচতে দাও না, বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতো।
এই গ্রামে এতগুলো মানুষতো থাকতো কিন্তু, তবুও তারা দিনের পর দিন এই মরণ নাটকটা দেখতে লাগল, কেউই তাকে সাহায্যের হাত বাড়াল না, এই ঘটনার দিনই বাবা-মা বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। যদিও আমাদের বাড়িটা গ্রামের একদম পশ্চিমকোনে আর বাকিদের বাড়ির থেকে দূরে কারণ গ্রামের ওই বিশাল পুস্করনী মানে বড় পুকুরটার ওইপাড়ে সবাই থাকত আর আমাদের বাড়িটা এই পাড়ে। তাই কেউ কোন খোঁজও করেনি সবাই জানত আমরা কোথাও বেড়াতে গিয়েছি। বাবা-মা হয়তো বাকীদের তাই বলে গেছেন গ্রাম ছাড়ার সময়। এইভাবে দিদি দিন-রাত শুধু একটাই প্রার্থনা করত কেউ তো আমাকে এখান থেকে তুলে নাও আমাকে বাঁচাও। এই মিনতি শুধু শুনেছে এখানকার সকল গাছপালা, এই ঘর-বাড়ি আর এই জড় পদার্থ ছাড়াও শুনছে কিছু দিবা-নিশাচর প্রাণীরা, এভাবে আমার দিদির প্রানটা চলে যায় পুরো এক সপ্তাহ পরে। ঠিক তার দুদিন পরে দিদির এক বান্ধবী তাকে খুঁজতে আসে বাড়িতে। বাড়িতে তালা ঝোলানো দেখে এক বুড়োকে জিজ্ঞাসা করে।" দাদু সান্তনার বাড়ির লোকজন সব কোথায় গেল বলতে পারেন? বুড়োটি তখন দিদির বান্ধবীকে ওই সাঁকোর দিকে দেখিয়ে বলল, ওই যে ওদের বাড়ি ওরা তো অনেক দিন হল বাড়িতে নেই দেখো। তবে বোন দুটিকেও তো অনেকদিন দেখিনি কি জানি তুমি দেখো গিয়ে কোন খোঁজ পাও কিনা।
অমৃতা সাঁকোটা পেরোতে যাবে এমন সময় একটা বৃশ্রী দুঃগন্ধ নাকে এল। উঁকি মেরে দেখতে পেল সান্তনার মৃতদেহ। অমনি চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকল। গ্রামের লোকজন জড় হল। কিন্তু আর কিছু হল না, পুলিশে খবর দিলে তারা আবার এসে গ্রামের লোকেদের নানা অজুহাতে পাকড়াও করে সে ভয়ে কেউ পুলিশ ডাকতে চাইল না, সুরঞ্জনদা খবর পেয়ে যখন এল তখন গ্রামের লোকেরা এই ড্রেনটাকে বন্ধ করে তার ওপর মাটি চাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ড্রেন এর মুখটা বন্ধ করে দিল। যদিও সুরঞ্জন দাদা পুলিশে খবর দিয়েছিলেন কিন্তু পুলিশ এই এত দূরে আসবার জন্য টাকা চেয়ে বসল, অনেক মিনতি করেও হল না।
এই ঘটনার কিছুদিন পর পর সুরঞ্জন দাদাকে আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক লোকজন আসতে দেখেছে। প্রায় একরকম বদ্ধ পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল দাদা। ওই যে আমলকী গাছ পেরিয়ে বুড়ো শিবমন্দির এখানেই একদিন গ্রামের কিছু মেয়ে-বউ এসে দেখে সুরঞ্জন দাদা গলায় দড়ি দিয়েছে।
গ্রামের মোড়লমশাই এলেন যখন দেখলেন পুলিশে খবর দিয়ে কোন লাভ নেই তখন তিনি গ্রামের কিছু লোকজনকে বলে পাশেই একটা কবর খুঁড়ে দাদাকে সমাধি দিলেন। সমাধি দেওয়ার সময় তারা সুরঞ্জন দাদার একটা সুইসাইড নোট পেয়েছিলেন,
সেখানে লেখা,
(চলবে...)
Comments
Post a Comment