আস্থা - ডঃ অসিত কুমার মাইতি ( ৪র্থ পর্ব)
অধ্যায় ৪: গভীর সন্ধান
ভীমডাঙার সকালে হালকা
কুয়াশা। আদিত্য মাটির ছোট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে অদ্ভুত উদ্বেগ। তার
হৃদয়ে একবারে জেগে উঠেছে অজানা এক প্রশ্ন—কেন তার জীবন যেন এক গোপন নিয়ন্ত্রণের
আওতায়?
নিজস্ব তদন্ত শুরু
আদিত্য বুঝতে পারল, এই
রহস্যময় খুন, অদ্ভুত ঘটনা সবই তার অতীতের সঙ্গে জড়িত। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল নিজের
হাতে সত্য খুঁজে বের করার।
সে রাতের আঁধারে মন্দিরের
পুরাতন খাজানা ঘরটি খুঁজে দেখতে গেল। ঘরে ঢুকে সে খুঁজে পায় এক ধূলোমাখা বাক্স,
যার ভেতর পুরনো পাণ্ডুলিপি, কিছু অক্ষর লেখা লোহার টুকরা, এবং এক পুরাতন চাবি।
পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলোতে ছিল কালীঘাট মন্দিরের প্রাচীন ভাষায় লেখা কিছু রহস্যময়
লেখা।
পাণ্ডুলিপির গোপন কথা
পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল—“যে
কেউ শিবের রূপে নিজেকে ধ্বংস করে, সে দেহান্তরের পরেও ফিরে আসে। কিন্তু তার অন্তরে
যদি ভয় হয়, তবে সে বোধহয় মুক্তি পায় না।”
আদিত্য বুঝল, এটি
শুধুমাত্র ভগবানের গল্প নয়, এটি তার নিজের জীবনের গল্প।
সুরভির অতীত উন্মোচন
সন্ধ্যায় আদিত্য সুরভির
সঙ্গে কথা বলল। সে জানাল তার সব সত্য—
“তার স্বামীর অন্ধকার
রহস্য
অগ্নিকাণ্ডের রাতে যা
ঘটেছিল
কেন সে শিবের পথ অনুসরণ
করল
কেন সে ফিরল নতুন এক রূপে,
প্রতিশোধ নিয়ে।”
সন্ধ্যার হালকা আলোয়
শিবমন্দিরের পেছনের ছোট বটগাছটার ছায়ায় বসেছিল আদিত্য ও সুরভি। বাতাসে গন্ধ ছিল
ধূপের, কিন্তু পরিবেশটা যেন ছিল থমথমে—প্রশ্নে ভারাক্রান্ত। বহু বছর পর, তারা
মুখোমুখি হয়েছিল এমন এক সন্ধ্যায়, যেখানে আলো কম, কিন্তু প্রশ্ন প্রচুর।
সুরভি চুপ করে ছিল
কিছুক্ষণ। চোখ নামানো, কণ্ঠে কান্নার স্পন্দন। তারপর বলল—
“আমার বিয়ে হয়েছিল তোমার
চলে যাওয়ার পর। বাবার চাপ, সমাজের চোখ—সব মিলিয়ে আমি রাজি না থেকেও ‘হ্যাঁ’
বলেছিলাম।
কিন্তু আমি জানতাম না, যে
মানুষটার সঙ্গে আমার বিয়ে হল, সে ভদ্রবেশী এক শয়তান।
প্রথম কয়েক মাসই
বুঝেছিলাম, ওর আসল রূপ... সে রাত্রিবেলা মদ খেত, আমায় মারত... আর ভয়ানক অন্ধবিশ্বাসে
ডুবে থাকত। এক রাতে আমি চোখে দেখেছি—সে শ্মশানে মানুষের রক্ত দিয়ে তান্ত্রিক
ক্রিয়া করছিল…” সুরভি থামল। মুখে চাপা আতঙ্ক।
“আমি যখন প্রতিবাদ করতাম,
তখন সে বলত—‘তুই শুধু শরীর, মন নয়। মন আমার অন্য কারো।’
একদিন আমায় ঘরে বন্দি করে
রাখল, তিন দিন। আমি জল না খেয়ে পড়ে রইলাম। তারপর কোনোমতে পালিয়ে এলাম।”
অগ্নিকাণ্ডের রাতে যা
ঘটেছিল
“আর সেই রাত? তোমার পরিবারের সেই ভয়ঙ্কর রাত...
আমি জানি, সেটা কেবল দুর্ঘটনা ছিল না।
আমি সেদিন ওর ব্যাগে পেয়েছিলাম এক নীল পাউডার,
কিছু আগুন ধরানো রাসায়নিক, আর তোমার বাড়ির ঠিকানা লেখা একটা পুরনো চিঠি।
আমি তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি... কিন্তু পরে
যখন শুনলাম তোমার মা, বাবা, ভাই সবাই পুড়ে মারা গেছে… আমি জানলাম, এটা শাস্তি নয়,
এটা ষড়যন্ত্র।”
সুরভির চোখ তখন অশ্রুতে
ভিজে যাচ্ছিল।
কেন সে শিবের পথ অনুসরণ
করল
“আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম। হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে গেছিলাম… ঠিক তখন এক সন্ন্যাসী আমায়
ধরেছিল।
সে বলেছিল—‘মৃত্যু নয়,
ধ্বংসের রূপে জন্ম নাও। শিবকে ডাকো, তিনি তুমাকে শক্তি দেবেন।’
তখন থেকেই আমি শিবের
আশ্রয়ে এসেছি। শিখেছি কিভাবে শ্বাস নিতে হয়, কিভাবে আগুনের মধ্যে দাঁড়াতে হয়।
আমি বুঝেছি, প্রেম শুধু
পাওয়া নয়—প্রেম মানে রক্ষা করাও।”
কেন সে ফিরল, নতুন এক রূপে
- “আমি ফিরেছি, কারণ
প্রতিশোধ আমার লক্ষ্য নয়—সত্যের মুখো মুখি করা আমার দায়িত্ব।
আমি তোমাকে ভালোবাসতাম,
আদিত্য। এখনো বাসি। কিন্তু ঈশ্বর আমায় শিখিয়েছেন—ভালোবাসা যদি সঠিক না হয়, তবে
সেটা শুধু দুর্বলতা।
আমি এখন দুর্বল নই।”
সে এক দৃষ্টিতে চাইল
আদিত্যর দিকে। সেই দৃষ্টিতে প্রেম ছিল, কষ্ট ছিল, কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল তেজ।
সুরভি নিচু গলায় বলল—“আমি
ভেবেছিলাম, প্রেম আমাদের বাঁচাবে।
কিন্তু ঈশ্বর আমাকে
শিখিয়েছেন, বাঁচাতে হলে নিজেকে পোড়াতে হয়।
আমি পুড়েছি, এখন আমি শুধুই
প্রেমিকা নই… আমি শিবের এক চরণ।”
(চলবে…)
Comments
Post a Comment