সেই গন্ধটা আজও আছে (পর্ব - ৪) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি




 “আজ থেকে ছয় বছর আগে আমার সাথে সান্তনার সাক্ষাৎ হয়। তাতে আমরা পরস্পরের প্রেমে পড়ে যাই। বিয়ের কথাও হয়েছিল বিয়েতো হলোই না। আসলে সারা বিশ্ব-প্রকৃতি তাকে আমার কাছে পাঠালেও শুধু এই একটা জাতি তাকে আমার কাছে আসতে দিল না, আর সেটা হল মনুষ্য জাতি। তাছাড়া আমার এই মৃত্যু কেন হল কিভাবে হল কারা দায়ী সেকথা কেউ না জানলেও চলবে। যা কিছু সিদ্ধান্ত তা সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্ত।”

কথাগুলো শেষ হতে না হতেই আমি আর যেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন দিলাম অমনি আমি যেন ঘন ধোঁয়াশার মধ্যে চলে গেলাম, সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

আমার হুঁশ ফিরল মোহন দও, আরও কিছু জনের গলার ডাকে। উঠে দেখলাম মোহন দও, রমেশ ড্রাইভার সঙ্গে আরও আট-দশজন লাঠিয়াল সর্দার বড় বড় লাঠি আর বড় লণ্ঠনের আলো নিয়ে আমায় খুঁজতে এসেছে।

মোহন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, জোরে জোরে দম ছেড়ে স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছে। রমেশ ড্রাইভার বলল," বাবু আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি তো, আপনি এতক্ষন কী করছিলেন? শুধুই কী ঘুরে বেড়াচ্ছেন নাকি? কোন কিছু দেখেছিলেন নাকি? এমন অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছেন।

আমি হেসে বললাম, আরে আমিতো এখানে একটা বোনের সাথে এতক্ষন জমিয়ে গল্প করলাম। এখানকার অতীত সম্বন্ধে শুনলাম। কেন আজ জায়গাটা এতটা শুনশান হয়েছে। দুজন বসে গুরু- রুটি খেলাম, জল খেলাম, গল্পটা প্রায় শেষ হতে যাবে আমি যেইমাত্র সিগারেটে আগুন দিলাম তারপর আমার কিছু মনে নেই তারপর তোমাদের গলার ডাক শুনতে পেলাম। মেয়েটি গেল কোথায়? সে কি তোমাদের খবর দিল, হয়ত আমার মাথাটা ঘুরে গেছিল বা সুগারটা ফল করেছিল।

 

আরে কী হলো কী সবাই অবাক হচ্ছো যে, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা, আমি জানি তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না। একজন লাঠিয়াল তখন বলল,' বাবু আপনি কোন রাস্তা দিয়ে এপারে এলেন, আমি বললাম কেন, ওদিকের লোহার সাঁকোর ওপর দিয়ে। সে বলল, “আপনি ঠিক জানেন।’’ আবার বললাম, “হ্যাঁ।”

 

তারা তখন টর্চের আলোটা নর্দমায় ফেলে বলল, এই দেখুন আপনার পার হওয়া লোহার সাঁকোটা। হ্যাঁ আপনি কোন বাড়িতে গল্প করছিলেন, আমি হাত দেখিয়ে বলালাম ওই বাড়িটায়। তাদের টর্চের আলোতে দুটো দেখার পর আমার শরীরের রক্ত হিম্ হয়ে গেল। প্রথমত, লোহার সাঁকোটা মাঝবরাবর ভেঙে নর্দমার মধ্যে পড়ে আছে আর দ্বিতীয়ত, যেই বাড়িতে আমি এতক্ষন কাটালাম সেই বাড়ির দরজার সামনে অসংখ্য মাকড়শার জাল জড়িয়ে একাকার। আর দরজাটা আধো ভাঙা। তবুও তাদের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে একটু এগিয়ে বাড়ির ভেতরে মারতে দেখলাম দেওয়ালে একটা ছবি ঝুলছে। যার কয়েকটা কাঁচ ভেঙে গেছে।

আমি এতক্ষন যার সাথে গল্প করছিলাম, যে আমায় জল দিল। ছবিটা তাঁরই, আর ঘরের মধ্যে টেবিলের ওপর কয়েকটা বই, আলনায় সেই কয়েকটা জামা-কাপড়, কিন্তু ঝুল-কালি পড়ে তারাও দিন্তান্তের গোধূলির কোলে ঘুমিয়ে পড়ছে। ওখান থেকে আমাদের হোটেলে ফিরে আমি তখন ঘড়িতে রাত ১টা ১৫ মিনিট। সবাই খেতে বসল, আমিও বসলাম, কিন্তু তখন ও আমার খিদে পাচ্ছিল না।



ওই অচেনা বোনটির খাইয়ে দেওয়া গুড়-রুটি আর তার 'সুন্দর মুখখানা আমার মনের মধ্যে বারংবার বিদ্যুতের চমকের মতো ভেসে উঠছে, তখনও যেন নাকে আসছে জল-কাদায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া শুকনো পাতাগুলো আর নর্দমার এঁদো এঁদো গন্ধটা।


- সমাপ্ত -

Comments

Popular posts from this blog

দীপ্তি-তিমির আলয় (পর্ব ১) - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

গোধূলি - ডঃ অসিত কুমার মাইতি

🎨 রঙে রঙে অচিনপুর🎨 এক অচেনা চিত্রশিল্পীর গল্প - ডঃ অসিত কুমার মাইতি